বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। তাদের প্রথম ১০০ দিন একদিকে যেমন দেশকে নতুন পথে এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, অন্যদিকে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় তাদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমার অভিজ্ঞতার মতে, তাদের অর্জন ও সীমাবদ্ধতার কিছু বিষয় নিয়ে নিম্নে আলোচনা করেছি-
ইতিবাচক দিক
১. সংস্কার প্রচেষ্টা
অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রকে নতুনভাবে বিনির্মাণের লক্ষ্যে দশটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এই কমিশনগুলোর কাজ সংবিধান, বিচার বিভাগ, পুলিশ, দুর্নীতি দমন, এবং জনপ্রশাসনে কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে সহায়তা করা। এ প্রচেষ্টা সরকারের একটি বড় অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে।
২. অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার
সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় দেশের অর্থনীতি ছিল সংকটে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে এবং রপ্তানি আয় সেপ্টেম্বরে ৭% এবং অক্টোবরে ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা এসেছে এবং দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় শীর্ষ অর্থনীতিবিদদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে রিজার্ভ ব্যবহার না করায় এই অর্জন বেশ প্রশংসিত হয়েছে।
৩. মানবিক উদ্যোগ
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা এবং শহীদ পরিবারের জন্য অর্থ সহায়তা ও পুনর্বাসন তহবিল গঠন সরকারের মানবিকতার পরিচয় বহন করে। আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য এই পদক্ষেপ সরকারকে জনসমর্থন এনে দিয়েছে।
৪. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
আন্তর্জাতিক মহল থেকে সরকারের প্রতি ব্যাপক সমর্থন এসেছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা সরকারের সংস্কার প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানিয়ে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বহির্বিশ্বে সরকারের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে, যা অর্থনীতি এবং কূটনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
৫. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পুনঃস্থাপন
সরকার ক্ষমতায় আসার পর গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে এবং বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে। এই পদক্ষেপ জনগণের তথ্য জানার অধিকার সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
নেতিবাচক দিক
১. আইনশৃঙ্খলার অবনতি
১০০ দিনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি এবং দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সাধারণ মানুষের মধ্যে এটি হতাশা তৈরি করেছে, যা সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা বাড়াচ্ছে।
২. সংস্কারে ধীরগতি
যদিও সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে, তবে তাদের কার্যক্রমের দৃশ্যমান অগ্রগতি খুবই কম। জনগণের মধ্যে সংস্কারের বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
৩. আন্দোলনের স্থায়ী সমাধানের অভাব
ছাত্র-জনতার চলমান অসন্তোষ সরকার পুরোপুরি থামাতে পারেনি। কিছু ক্ষেত্রে তাদের প্রতিক্রিয়া ধীর বলে মনে করছে সাধারণ মানুষ।
৪. সুশাসনের অভাব
সংগঠনের ভেতরে স্বচ্ছতা এবং প্রশাসনিক সক্ষমতার অভাবকে অনেকেই সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন না করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিশেষে, অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন নিয়ে সাধারণ মানুষের মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সরকার তার সংস্কার এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মাধ্যমে একটি ইতিবাচক দিক দেখিয়েছে, তবে আইনশৃঙ্খলা ও দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে তাদের সীমাবদ্ধতা জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে। আগামি দিনগুলোতে সরকারকে দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে তারা তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণে সক্ষম হয় এবং একটি স্থিতিশীল ও উন্নত রাষ্ট্র গঠনে সফল হয়।