মৃত্যুদিনে স্মরণে কিংবদন্তি উৎপল দত্ত!

 


গণনাট্য আন্দোলনের অন্যতম অগ্রপথিক, জনগণের নাট্যকার নাট্যপরিচালক অভিনেতা উৎপল দত্ত। নিজের সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি শিল্পী নই। নাট্যকার বা অন্য যে কোনো আখ্যা লোকে আমাকে দিতে পারে। তবে আমি মনে করি আমি প্রপাগান্ডিস্ট। এটাই আমার মূল পরিচয়।’- সেই বিচিত্র নাট্যব্যক্তিত্ব উৎপল দত্ত। পুরো নাম উৎপলরঞ্জন দত্ত। আজ এই কিংবদন্তি বাঙালির মৃত্যুবার্ষিকী। 

জন্ম ১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ অবিভক্ত বাংলার বরিশালের কীর্তনখোলায়। বাবা গিরিজারঞ্জন দত্ত ও মা শৈলবালা দত্ত। পড়াশোনা করেছেন শিলঙের এডমন্ডস স্কুলে, পরে কলকাতার সেন্ট লরেন্স, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। ১৯৪৮ সালে ইংরেজি অনার্স নিয়ে স্নাতক করেন তিনি। কলেজের ছাত্রদের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করেন উৎপল। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ইংরেজি অনার্সে তাঁর স্থান হয় পঞ্চম। স্কুলজীবনেই বাবা-মায়ের সঙ্গে পেশাদারি থিয়েটার দেখা শুরু এ মানুষটির। এবং প্রথম দর্শনেই প্রেম, যার উক্তি পাওয়া যায় পরবর্তীকালে তাঁর কথায়- ‘সেই সব মহৎ কারবার দেখে মনে হলো, আমার পক্ষে অভিনেতা ছাড়া আর কিছুই হওয়ার নেই। আমার বয়স তখন তেরো।’

উৎপল দত্ত কেবলমাত্র একজন অভিনেতা, নির্দেশক বা লেখকই ছিলেন না, তাঁর রাজনীতির আদর্শ ছিল বামপন্থা ও মার্ক্সবাদ। কলেজ জীবনেই অভিনয় শুরু করেন উৎপল। ১৯৪৭ সালে নিকোলাই গোগলের ‘ডায়মন্ড কাটস ডায়মন্ড’ এবং মলিয়েরের ‘দ্য রোগারিজ অব স্ক্যাপা’ দিয়েই তার কলেজ জীবনের অভিনয় শুরু। নাটক দুটি প্রযোজনা করেছিল কলেজের ইংরেজি একাডেমি এবং পরিচালনায় অধ্যাপক ফাদার উইভার। ক্রমশ উৎপল ও কলেজের কয়েকজন সহপাঠী মিলে গড়ে তোলেন একটি নাট্যদল- ‘দ্য অ্যামেচার শেক্সপিয়ারিয়ান্স’। তাদের প্রথম উপস্থাপনা ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ এবং ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের নির্বাচিত অংশ।

সেই সময়েই, ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে, ইংল্যান্ডের বিখ্যাত পরিচালক ও অভিনেতা জেফ্রি কেন্ডাল তাঁর ‘শেকসপিয়ারিয়ানা’ নাট্যদল নিয়ে ভারত সফরে আসেন। কেন্ডালের আহ্বানে উৎপল যোগ দেন সফররত সেই নাট্যদলে। ১৯৪৭-এর অক্টোবর থেকে জানুয়ারি ১৯৪৮ পর্যন্ত শেকসপিয়ারিয়ান নাট্যদল কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে তাদের প্রযোজনা মঞ্চায়ন করে। নাট্যমোদীরা অভিভূত হন। জেফ্রি কেন্ডালের দলে তখন নিয়মিত অভিনয় করেছেন তিনি। ইউরোপীয় থিয়েটার দলের শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা উৎপলের নাট্যজীবনে ফেলেছিল বিশেষ প্রভাব। কেন্ডালের কাছেই শিখেছিলেন- There is no art without discipline and no discipline without sacrifice. তাঁর কাছেই উৎপল পেয়েছেন শেকসপিয়রের নাটকে অভিনয় করার বিশেষ শিক্ষা।

১৯৫৯ সালে লিটল থিয়েটার গ্রুপ কর্তৃক মিনার্ভা থিয়েটার অধিগ্রহণ ও নিয়মিত নাট্যাভিনয়ের কর্মসূচি গ্রহণ এবং তাঁর পরিচালনায় তাঁরই লেখা ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারি ফৌজ’, ‘কল্লোল’ প্রভৃতি নাটকে রাজনৈতিক বোধ, আঙ্গিক প্রয়োগ- নাটক ও নাট্যাভিনয়ের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। গ্রুপ থিয়েটার অঙ্গনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয় এই শিল্পীকে। এ ছাড়া ১৯৭১ সালে পিপলস লিটল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে ‘টিনের তলোয়ার’ নাটক তাঁর একটি বড় পদক্ষেপ। কৌতুক অভিনেতা হিসেবেও তাঁর খ্যাতি রয়েছে। কৌতুক চলচ্চিত্র গুড্ডি, গোলমাল ও শৌখিন-এ অভিনয় করেছেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় হীরক রাজার দেশে, জয় বাবা ফেলুনাথ এবং আগন্তুক সিনেমায় তাঁর অনন্য অভিনয়-প্রতিভা দেখেছেন বাংলার দর্শক। তাঁর বিখ্যাত নাটকের মধ্যে রয়েছে টিনের তলোয়ার, মানুষের অধিকার, মেঘ, রাইফেল, সীমান্ত, ঘুম নেই, মে দিবস, দ্বীপ, রাতের অতিথি, মধুচক্র, কল্লোল, সমাজতান্ত্রিক চাল, সমাধান ইত্যাদি।

উৎপলের রাজনৈতিক নাটকগুলোর মধ্যে পাওয়া যায় শ্রেণিচেতনা, ইতিহাস চেতনা ও মধ্যবিত্ত চেতনা। ‘টিনের তলোয়ার’, ‘রাতের অতিথি’, ‘ছায়ানট’, ‘সূর্যশিকার’, ‘মানুষের অধিকার’ প্রভৃতি নাটকে যেমন পাওয়া যায় শ্রেণিসচেতনতা, তেমনি ‘টোটা, ‘লাল দুর্গ’, ‘তিতুমীর’, ‘কল্লোল’, ‘দিল্লি চলো’, ‘ক্রুশবিদ্ধ কুবা’ প্রভৃতি নাটকের ইতিহাস চেতনা, ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারি ফৌজ’ প্রভৃতি নাটকের মধ্যবিত্ত চেতনা তাঁর নাটককে দেয় ভিন্নমাত্রা। নাটক, যাত্রাসহ বহু বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও ব্যাপক খ্যাতির অধিকারী হন উৎপল দত্ত। তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে বিদ্যাসাগর (১৯৫০), মাইকেল মধুসূদন (১৯৫০), চৌরঙ্গী (১৯৬৮), ভুবন সোম (১৯৬৯), গুড্ডি (১৯৭১), ক্যালকাটা ৭১ (১৯৭১), শ্রীমান পৃথ্বীরাজ (১৯৭৩), ঠগিনী (১৯৭৪), যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪), কোরাস (১৯৭৪), পালংক (১৯৭৫), অমানুষ (১৯৭৫), জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৮), গোলমাল (১৯৭৯), হীরক রাজার দেশে (১৯৮০), আঙ্গুর (১৯৮২), পার (১৯৮৪), পথভোলা (১৯৮৬), আজ কা রবিনহুড (১৯৮৭), আগন্তুক (১৯৯১), পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯৩) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রও পরিচালনা করেছেন তিনি।

উৎপল দত্ত পরিচালিত ছবি- মেঘ, ঘুম ভাঙার গান, ঝড়, বৈশাখী মেঘ, মা প্রভৃতি। তিনি নাট্যবিষয়ক বহু প্রবন্ধ ও একাধিক গ্রন্থের রচয়িতাও।

বিচিত্র প্রতিভার নাট্যব্যক্তিত্ব উৎপল দত্তের সৃষ্টিশীল জীবনের অবসান ঘটে ১৯৯৩ সালের ১৯শে আগস্ট কলকাতায়। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে পর্যন্ত সক্রিয় ছিল তার নাট্যভাবনা। ১৯৮৮ থেকেই তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায়। কিন্তু ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়েও মঞ্চে ও সিনেমায় অভিনয় করে গেছেন। অসুস্থ্য অবস্থাতেও ১৯৯২ এ ‘আগুন্তুক’ চলচ্চিত্রে জীবনের অন্যতম সেরা অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।

আজ মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি এই কিংবদন্তী'কে🖤

Post a Comment

Previous Post Next Post